
আজ ১৩ নভেম্বর। অন্যদিনের মতোই পূবাকাশে সূর্য উঠবে; পশ্চিমে অস্ত যাবে। তবুও এটা অন্য ১০টা দিনের মতো নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে দিনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেন? কারণ গত বছর গণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজ রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণ হওয়ার কথা রয়েছে। এদিন লকডাউন ঘোষণা করেছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা দল আওয়ামী লীগ। তারা ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ ৮টি দল তাদের প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে। সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। সব মিলিয়ে ত্রিমুখী সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। সংঘাত হলে বহু মানুষের প্রাণহানি হতে পারেÑ যা কারোই কাম্য নয়।
অনেকদিন ধরেই রাজনীতিতে কথার উত্তাপ চলছে। রাজনীতিতে অনুপস্থিত আওয়ামী লীগকে অনেকে দোষারোপ করছেন। ১৫ মাস ধরে হামলা-মামলার শিকার দলটির নেতাকর্মীদের নতুন করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ১৩ নভেম্বরের সংঘাত এড়াতে। তাদের গ্রেপ্তার করে যদি এই সংঘাত এড়ানো যায়, সেটা খুবই ভালো কথা। কিন্তু সংঘাত ঠেকানো যাবে কি-না, সেই প্রশ্ন যেমন সামনে আসছে, তেমনি মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কী হবে আজ? রক্তের বন্যা বয়ে যাবে না তো? আজ কী অনেক মানুষের প্রাণহানি হবে? এসব প্রশ্ন উঠার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কেননা, এরই মধ্যে ফিরে এসেছে আগুন সন্ত্রাস। বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সেই আগুনে পুড়ে মারা গেছে ময়মনসিংহের বাস চালক জুলহাস মিয়া। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখছে তার পরিবার। জুলহাসের মায়ের প্রশ্ন ‘আমার ছেলে তো রাজনীতি করতো না। তাকে কেন পুড়িয়ে মারা হলো?’ সন্তান হারানো মায়ের এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কারো জানা নেই। বুধবার এই আর্টিকেল যখন লিখছিলাম ঠিক সেই সময় গাজীপুরের শ্রীপুরে বাসে আগুন দেওয়ার খবর এলো টেলিভিশনের পর্দায়। আর আগে দুপুর ১টার দিকে রাজধানীর মিরপুরে সনি সিনেমার সামনে শতাব্দী পরিবহন নামে একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। বাসটির সামনের দিকের কয়েকটি আসন পুড়লেও কেউ হতাহত হয়নি বলে জানান শাহ আলী থানার ওসি।
এদিন ভোরে গাজীপুরে আলাদা স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। সাভারের আশুলিয়ায় আগুন দেওয়া হয়েছে আরেকটি বাসে। ঢাকার কাকরাইলে রমনা থানার সামনে আগুনে পুড়ে গেছে পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যান। আর রাজধানীর উত্তরায় পুড়েছে একটি মাইক্রোবাস। মোহাম্মদপুরে প্রিপারেটরি স্কুলে পেট্রোল বোমা ছোড়া হয়েছে। মঙ্গলবার ইস্পানি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। সোমবার ঢাকার অন্তত সাতটি স্থানে হাতবোমা বিস্ফোরণ ও তিন গাড়িতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এরপর সোমবার গভীর রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত ঢাকার রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরায় তিনটি বাসে আগুনের খবর দেয় ফায়ার সার্ভিস। মঙ্গলবার ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় পুড়ে মারা গেছেন চালক জুলহাস মিয়া। এমনকি মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ের সামনেও একটি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। অভুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির কার্যালয়ের সামনেও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এ সময় একজনকে আটক করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার মামলার রায় ঘোষণার তারিখ নির্ধারণের কথা জানানোর পর সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো ঢাকা কেন্দ্রিক কর্মসূচিও ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য এক ভিডিও বার্তায় সম্প্রতি ১০ থেকে ১৩ই নভেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ এবং ১৩ই নভেম্বর ঢাকা ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় সরকার ও আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। বিভিন্ন জায়গায় বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এর প্রতিবাদে মিছিল সমাবেশও করেছে। জামায়াতে ইসলামী সমর্থিত নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘জুলাই ঐক্য’ নামক একটি মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি প্রতিরোধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রোববারই সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকেই জানানো হয়- কয়েকটি জেলা থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঢাকায় এসেছে। বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, ‘১৩ই নভেম্বর ঢাকা লকডাউন নিয়ে কোনো ধরনের শঙ্কা নেই বলে মনে করেন তারা।’
তবে কয়েকটি বাসে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ ও একজনের প্রাণহানির পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায় আমার মতো অনেকেই ভরসা রাখতে পারছেন না। আগুন সন্ত্রাসের জন্য আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করা হলেও দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম এবং মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত সহিংসতা কিংবা নাশকতার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। আরাফাত বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার সুযোগ নিয়ে সরকারের প্রশ্রয় পাওয়া সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো এ ধরনের নাশকতা করতে পারে। আওয়ামী লীগ শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করবে।’ (বিবিসি বাংলা, ১২ নভেম্বর ২০২৫)।
আওয়ামী লীগ নেতা আরাফাত ও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায় কিন্তু আমরা আস্থা রাখতে পারছি না। কারণ এরই মধ্যে বিভিন্ন জেলা থেকে আওয়ামী লীগের লোকজন ঢাকায় এসেছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বলা হয়েছে। গণভোটের তারিখ ঘোষণার দাবিতে জামায়াতসহ ৮ দলের নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার কথা শোনা গেছে। ফলে তারা সংঘাতে জড়াতে পারেন বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ আমাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের কথা বলা যায়। সেদিন সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সব চেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয় রাজধানীর পল্টন এলাকায়। এতে পাঁচজন নিহত হয়। তাদের চারজন জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী এবং একজন ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মী। সারাদেশে মোট প্রাণ হারিয়েছিলেন ১৩ জন। ইংরেজি দৈনিক দ্য নিউ এজের শেষ পাতায় অস্ত্র হাতে দুই যুবকের ছবি পাশাপাশি ছাপা হয়েছিল। সেখানে দুটি ছবির একটিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী প্রতিপক্ষের দিকে গুলি করেছে। আরেকটি ছবিতে বলা হয়েছে, শিবিরের একজন কর্মী প্রতিপক্ষের দিকে পিস্তল তাক করেছে। দিনটি ছিল চারদলীয় জোটের শেষদিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগ নিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। লগি-বৈঠা নিয়ে দলটির হাজারো নেতাকর্মী সেদিন রাস্তায় নেমেছিল। পাল্টা কর্মসূচি দিয়েছিল জামায়াতে ইসলামী। বিএনপির কর্মসূচিও ছিল। তবে ১৪ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা সেদিন মাঠে নামলেও সংঘাতে ছিল আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী। আবার সেই দুটি দল মুখোমুখি। সুতরাং বিষয়টিকে হালকা ভাবার কারণ নেই। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে অবশ্যই কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে; সংযম দেখাতে হবে। লেখক: সাংবাদিক
